শিশুর জন্মের আগেই অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন!
প্রকাশিত : ১৮:৪২, ২৮ মে ২০১৮ | আপডেট: ১৭:৪৬, ৩১ মে ২০১৮
মায়ের সঙ্গে এলিয়ানা
জন্মের আগেই শিশুর শরীরে রক্ত সঞ্চালন ও অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন? এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে আমেরিকায়। সদ্যোজাত শিশু এলিয়ানা কনস্ট্যান্টিনোর জন্মের তিন মাস আগেই তার একবার অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ও পাঁচ দফায় রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়েছে। এগুলো করা হয়েছে মায়ের তলপেট ও জরায়ুর মাধ্যমে তার শিরায় সুচ ঢুকিয়ে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি এলিয়ানার জন্ম হয়। মায়ের পেটে থাকতেই সে বংশগত আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর নামের রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগ রক্তের লোহিত কণিকাকে দেহে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা দেয়। এর ফলে তীব্র রক্ত স্বল্পতা, হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ ও মস্তিষ্ক অকার্যকর হয়। ফলে মাতৃগর্ভে ভ্রূণ নষ্ট হয়।
কয়েক দফা রক্ত দেওয়ায় মায়ের পেটে এলিয়ানা বেঁচে থাকে। এখনো তার শরীরে তিন সপ্তাহ পর পর তার শরীরে রক্ত দিতে হয়। কিন্তু মাতৃগর্ভ তার রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করা হয় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে। তবে এর সাফল্যের ব্যাপারে এত আগে কিছু বলা সম্ভব নয়।
এই চিকিৎসা কার্যকর হলে তা ভ্রূণে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রক্ত স্বল্পতা, হেমোফিলিয়া ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অন্য রোগ নিরাময়ের দুয়ার খুলে দেবে।
এলিয়ানার চিকিৎসা ও এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অধিভুক্ত ইউসিএসএফ বেনিওফ চিল্ড্রেন’স হাসপাতাল সানফ্রান্সিসকোর শিশু ও ভ্রূণ অস্ত্রোপচারের চিকিৎসক টিপি ম্যাকেঞ্জি। তিনি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘এই কাজ ভ্রূণে অস্ত্রোপচারের চিকিৎসাকে এগিয়ে নিল। ভ্রূণের ক্ষতি না করে এ অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা কঠিন ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।’
নিশেল ওবার (৪০) ও তাঁর স্বামী ক্রিস কনস্ট্যান্টিনো (৩৭) স্বাস্থ্যবান। কিন্তু প্রথম সন্তান পেটে আসার পর জানতে পারেন, তাঁরা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। এশিয়া, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের লাখ লাখ লোক থ্যালাসেমিয়ার বাহক। এর কারণে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী অন্তত এক লাখ শিশু নানা রোগ নিয়ে জন্ম নেয়। থ্যালাসেমিয়ার বাহকেরা স্বাস্থ্যবান হয়। কিন্তু দুজন বাহক মিলে সন্তান নিলে সন্তানের রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ওবারের মা-বাবা ফিলিপাইন ও পুয়ের্তো রিকোর নাগরিক। ওবারের স্বামী ক্রিস ফিলিপাইনের।
এ দম্পতির বসবাস হাওয়াই দ্বীপের কাওয়াই কাউন্টির কিলাউই শহরে। তাদের প্রথম সন্তান গ্যাব্রিয়েলের বয়স ৩ বছর। সে ভালো স্বাস্থ্যের। কিন্তু এ ধরনের দম্পতির প্রতি চারটি সন্তানের একটির রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ওবার দ্বিতীয় দফায় অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ১৮ সপ্তাহের মাথায় আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়। তাতে দেখা যায়, এলিয়ানার হৃদ্যন্ত্রের আকৃতি স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ। মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ ছিল অস্বাভাবিক দ্রুতগতির, যেটা রক্তস্বল্পতার লক্ষণ। ওবারের চিকিৎসক সতর্ক করে বলেছেন, তাঁদের মেয়েটি নাও বাঁচতে পারে।
চিকিৎসার পরিভাষায় এই অসুস্থতাকে ‘জীবনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ’ আখ্যায়িত করা হয়। এ ধরনের বেশির ভাগ ভ্রূণই মায়ের গর্ভে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। বাবা-মা গর্ভে সন্তান নষ্ট হওয়ার বিষয়টি নাও জানতে পারেন। অনেকে এও জানতে না পারেন যে, তাঁরা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত।
এলিয়ট ভিচিনস্কি একজন গবেষণা সহযোগী এবং ইউসিএসএফ বেনিওফ চিল্ড্রেন’স হসপিটাল অকল্যান্ডের নর্দার্ন ক্যালিফোর্নিয়া কম্প্রিহেন্সিভ থ্যালাসেমিয়া সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বলেন, ‘এখন প্রত্যেককে গর্ভপাত ঘটাতে বলা হয়।’ ‘আমরা মনে করি, পরিবারগুলোর সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমরা এটাই বলছি যে, তাঁদের সামনে বিকল্প আছে।’
কিছু চিকিৎসক রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যাপারে সতর্ক। কারণ এর মাধ্যমে শিশু বাঁচলেও তার মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে খুব বেশি।
গত বছর আন্তর্জাতিক একটি সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের শিশু বাঁচলেও তাদের ২০ শতাংশের স্নায়বিক বৃদ্ধি অনেক ধীর গতির হয়। আরেক নিবন্ধে এ হার ২৯ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়।
ম্যাকেঞ্জি জানান, ওবার গত বছরের অক্টোবরে ২১ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বার সময় প্রথম ইউসিএসএফে যান। তখন এলিয়ানা এত অসুস্থ ছিল যে, গবেষক দল মনে করেছিল সে প্রায় মৃত। কিছু সময়ের মধ্যে এলিয়ানাকে রক্ত দেওয়া হয়। দ্রুত তাঁর অবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকে। এরপর গবেষক দল ওবারের হিপের হাড় থেকে মজ্জা নিয়ে এলিয়ানার শরীরে প্রতিস্থাপন করে।
ম্যাকেঞ্জি বলেন, এক বিবেচনায় গবেষণা ইতিমধ্যে সফল হয়েছে। মা ও শিশু সন্তানের ওপর নেতিবাচক কোনো প্রভাব নেই। তাই চিকিৎসা নিরাপদ বলেই মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমি শিহরিত। অস্ত্রোপচার সফল ও নিরাপদ হয়েছে।’ তিনি এ ধরনের আরও কয়েকটি রোগীর অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে চান।
ওবার বলেন, ‘এলিয়ানার অবস্থা ভালো। তাই আমি হতাশ নই। ছোট ছোট সব অর্জনই আমরা উদ্যাপন করব। এটি করতে পেরে আমরা আনন্দিত।’
ব্রূণে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের প্রথম চেষ্টা হয় গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। ম্যাকেঞ্জি বলেন, তখন বেশির ভাগ চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসক উদ্যোগটি বাতিল করে দেন। তবে অন্য প্রাণীর ওপর গবেষণা চালিয়ে মৌলিক ফল পাওয়া যায়।
এসি